মানুষ নিজেকে যতই ক্ষমতাবান বা শক্তিশালী মনে করুক না কেন, আসলে সে কিছুই সৃষ্টি বা ধ্বংস করতে পারে না। মহান সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে যা-কিছু দিয়ে রেখেছেন তা রূপ পরিবর্তন করে নেড়েচেড়ে খাওয়া ছাড়া মানুষের কোনো হাত নেই। অতএব আমাদের কীসের এত বড়াই ও কেন এত জারিজুরি? সম্পদ বলুন আর ক্ষমতা বলুন, কিছুই চিরস্থায়ী নয়। শুধু মানুষের হাত বা স্থান পরিবর্তন হতে পারে। সবকিছুরই মালিক সেই মহান সৃষ্টিকর্তা।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অসংখ্য বস্তু ও পদার্থ বিদ্যমান, যা এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত হলেও কখনো সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয় না। বিজ্ঞানের ভাষায় এই সত্যকে বলা হয় বস্তুর অবিনাশীতাবাদ সূত্র। এটি রসায়নের অন্যতম মৌলিক নীতি, যা আমাদের শেখায় যে, কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পদার্থ সৃষ্টি বা বিনষ্ট হয় না; বিক্রিয়ার পূর্বে ও পরে পদার্থের মোট ভর সমান থাকে। অর্থাৎ কোনো বস্তু অদৃশ্য হয়ে যায় না বা হঠাৎ সৃষ্টি হয় না, কেবল রূপান্তরিত হয় এক পদার্থ থেকে অন্য পদার্থে।
এই সূত্রটি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন বিখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী অ্যান্টোয়ান ল্যাভয়জিয়ে (অহঃড়রহব খধঁৎবহঃ খধাড়রংরবৎ)। তিনি ১৭৭৪ সালে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় ভরের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। তিনি যখন টিন ও সীসা বাতাসে গরম করতেন, তখন দেখতেন ধাতুর ভর বেড়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে তিনি বুঝতে পারেন যে, এই অতিরিক্ত ভর এসেছে বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে ধাতুর বিক্রিয়ার কারণে। এর মাধ্যমেই তিনি ঘোষণা করেন, ‘পদার্থ সৃষ্টি বা বিনষ্ট হয় না, কেবল পরিবর্তিত হয়’। তাঁর এই আবিষ্কার রসায়ন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে এবং তাঁকে ‘আধুনিক রসায়নের জনক’ হিসেবে পরিচিতি দেয়।
বস্তুর অবিনাশীতাবাদ সূত্রকে সহজভাবে প্রকাশ করা যায় এইভাবে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিক্রিয়ক পদার্থের মোট ভর এবং উৎপন্ন পদার্থের মোট ভর সমান থাকে। যেমন, ম্যাগনেশিয়াম যখন বাতাসে জ্বলে, তখন এটি অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ম্যাগনেশিয়াম অক্সাইড তৈরি করে। এখানে ম্যাগনেশিয়াম ও অক্সিজেনের ভরের যোগফল সমান হয় উৎপন্ন ম্যাগনেশিয়াম অক্সাইডের ভরের সঙ্গে। কোনো ভর নষ্ট হয় না বা নতুন করে তৈরি হয় না, কেবল রাসায়নিক রূপ পরিবর্তিত হয়।
এই সূত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। রাসায়নিক সমীকরণ নির্ণয় ও ভারসাম্য স্থাপনের ক্ষেত্রে এই সূত্র অপরিহার্য। শিল্পক্ষেত্রে পদার্থের পরিমাণ নির্ধারণ ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায়ও এটি ব্যবহার করা হয়। বস্তুর অবিনাশীতাবাদ সূত্র শক্তি সংরক্ষণ সূত্রের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। কারণ উভয় সূত্রই প্রমাণ করে যে, প্রকৃতিতে কিছুই সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায় না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই সূত্রের ব্যবহার আরও বিস্তৃত হয়েছে।
পরে আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্বে প্রমাণ করেন যে, পদার্থ ও শক্তি আসলে একই মূল সত্তা, যা একে অপরের রূপে রূপান্তরিত হতে পারে। তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ অনুযায়ী- ভর ও শক্তির মধ্যে সম্পর্ক আছে। তবে সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে শক্তি পরিবর্তনের পরিমাণ এত অল্প যে তা ভরের হিসেবে প্রায় ধরা যায় না। তাই দৈনন্দিন জীবনের ও সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বস্তুর অবিনাশীতাবাদ সূত্রকে সম্পূর্ণ সত্য বলে ধরা হয়।
সর্বোপরি, বস্তুর অবিনাশীতাবাদ সূত্র বিজ্ঞানের এক মৌলিক ও চিরন্তন সত্য। এটি মানুষকে বুঝতে সাহায্য করেছে যে প্রকৃতিতে কিছুই নষ্ট হয় না কেবল রূপান্তরিত হয়। অ্যান্টোয়ান ল্যাভয়জিয়ের এই সূত্রের মাধ্যমে মানুষ পদার্থের গঠন ও পরিবর্তনের প্রকৃতি গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে। তাঁর এই আবিষ্কার আধুনিক রসায়ন বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছে এবং আজও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
তাই আসুন, আমরা আমাদের ক্ষমতা ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার করি। মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির প্রতি মনেপ্রাণে আনুগত্য স্বীকার করি। তারপর একদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে গিয়ে হিসাব দাখিল করতে প্রস্তুত হই।
পবিত্র কুরআনের শেষ আয়াতে বলা হয়েছে :
“আর তোমরা ভয় কর সেই দিনকে, যেদিন তোমরা পুনরায় ফিরে যাবে আল্লাহর কাছে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কর্মফল পুরোপুরি পাবে। আর তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না”
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার ও সোনামুখ স্মার্ট একাডেমি।
খুলনা গেজেট/এএজে

